নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা। নারী শিক্ষার গুরুত্ব রচনা(১৫ পয়েন্ট)
নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা। নারী শিক্ষার গুরুত্ব রচনাঃআসসালামু আলাইকুম শিক্ষার্থী বন্ধুরা, তোমাদের জন্য নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা রচনা সহজ ভাষায় উপস্থাপন করা হলো।
নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা
নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা রচনাটি দেখে নাও একনজরে।
নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ভূমিকা
মানুষের পাঁচটি মৌলিক অধিকারের অন্যতম হলো শিক্ষা, যা বাংলাদেশের মহান সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত। অন্নবস্তু- বাসমান ও চিকি চিকিৎসা যেমন প্রতিটি মানুষের প্রয়োজন, তেমনি শিক্ষার অধিকারও প্রতিটি মানুষের জন্যে নিশ্চিত হওয়া উচিত। শিক্ষার ক্ষেত্রে কোনো প্রকার বৈষম্য স্বীকৃত হতে পারে না। তা সত্ত্বেও আমাদের সমাজে নারীরা নানাদিক দিয়ে পুরুষের চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে। ফলশ্রুতিতে দেশ ও জাতি কাঙিক্ষত অগ্রগতির পথে অগ্রসর হতে পারেনি।
শিক্ষা কী
শিক্ষা একটি বিশেষ প্রক্রিয়া, যার মধ্য দিয়ে মানুষ তার ভেতরের সম্ভাবনাময় শক্তিকে বিকশিত করতে পারে। এরিস্টটল শিক্ষা বলতে বুঝিয়েছেন, মানুষের দেহ ও মনের সমন্বিত বিকাশ। শিক্ষাবিজ্ঞানে শিক্ষা বলতে বোঝায়, মানব আচরণের ইতিবাচক পরিবর্তন। অপরদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিক্ষাকে মানবচেতনার পরিপুষ্টি ও উন্নত ভাবাদর্শের উৎসারক বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। প্রকৃতপক্ষে, শিক্ষা হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় মানুষের সহজাত সক্ষমতার বিকাশ এবং তার জ্ঞানচক্ষুর উন্মোচন। এটি মানুষের প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠার সোপান।
শিক্ষার মানবিক প্রয়োজনীয়তা
মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব। কিন্তু জন্মমাত্রই যে মানুষ এ শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারে তা কিন্তু নয়। শিক্ষাই মানুষকে সাধারণ প্রাণীস্তর থেকে মনুষ্যত্বের মর্যাদায় অভিষিক্ত করে। শিক্ষার আলোয় আলোকিত, আনচক্ষু উন্মোচিত, মানবিকতার চেতনা অর্জনকারী মানুষ আশরাফুল মাখলুকাতের পর্যায়ে সমুন্নত হয়। শিক্ষার এই সাধারণ প্রয়োজনকে বিশেষ কারো জন্যে অস্বীকার বা অবহেলা করা হলে তার প্রতি শুধু অন্যায়ই করা হয়। তাই শিক্ষার মূল প্রয়োজন মানবিকতার সাথে সম্পর্কিত।
শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য
শিক্ষা নাগরিকের মৌলিক অধিকার হলেও আমাদের সমাজে নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে শিক্ষার অধিকার সমান নয়। যুগ যুগ ধরে নারীরা শিক্ষাক্ষেত্রে পেয়েছে নিতান্তই সামান্য সুযোগ। শিক্ষা সম্পর্কিত পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে নারীশিক্ষার সূচক উর্ধ্বমুখী মনে হলেও সামগ্রিক অবস্থাটা এখনও সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছেনি। আমাদের দেশে শিক্ষার সামগ্রিক হার যেখানে শতকরা ৬৫'র মতো, সেখানে নারীদের মধ্যে শিক্ষার হার এখনও ৪০ ভাগের নিচে। অথচ নারী-পুরুষের সমান্তরাল শিক্ষা-সুযোগ নিশ্চিত না করা গেলে আমাদের জাতীয় উন্নতির কল্পনা করা দিবাস্বপ্ন ছাড়া যে কিছুই নয়।
নারীশিক্ষার প্রতিবন্ধকতা
আমাদের সমাজে নারীশিক্ষা প্রসারের পথে নানা প্রকার প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। প্রথমত, ধর্মীয় কুসংস্কার ও অবরোধ প্রথার কারণে মুসলমান সমাজে নারীদের ঘরের বাইরে পাঠিয়ে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার ক্ষেত্রে। জমালেনক্ষ্যযোগ্য। এ কুসংস্কার আজও কাটেনি। পুরুষশাসিত সমাজে পুত্রসন্তান পিতার সামাজিক উত্তরাধিকারকে বহন করে। তাই সমাজে সুশিক্ষিত ছেলেসন্তান রেখে যাবার আকাঙ্ক্ষা থেকে ছেলেদের শিক্ষার ক্ষেত্রে বেশি যত্ন লক্ষ করা যায়।
অপরদিকে পিতানাতা বৃদ্ধ হলে পুত্রের আশ্রয় লাভের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক স্বার্থ থেকে ছেলেদের শিক্ষার প্রতি অতিমাত্রায় জোর দিতে গিয়ে মেয়েসন্তানের শিক্ষাকে উপেক্ষা করে থাকে। অভিভাবকরা মনে করে, সংসারে কন্যা সন্তান বিবাহপূর্ব সময় পর্যন্ত অতিথিতুল্য। তাকে কোনোদরে বিয়ে দিতে পারলেই দায়িত্ব শেষ। কাজেই তাদের মতে মেয়েদের আধুনিক শিক্ষাদান মানে অর্থের অপচয়।
মানবিক প্রয়োজনে নারীশিক্ষা
নারী জাতিকে যথাযথ মানুষ রূপে গড়ে তুলে তাদের মানবিক মূল্যটুকু নিশ্চিত করার জন্যই নারীশিক্ষার প্রয়োজন। নারীর আত্মজাগরণ, অধিকার সচেতনতা ও মানবিকতার বিকাশে শিক্ষা গ্রহণ ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। শিক্ষার অভাবে নারীরা একদা পুরুষের সেবাদাসীতে পরিণত হয়েছিল। শিক্ষার জাগতিক ও ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার না করে কেবল মানবিক প্রয়োজনটুকু আমাদের উপলব্ধি করার সময় এসেছে।
জাতিগঠনে নারীশিক্ষার গুরুত্ব
পৃথিবীর উন্নত জাতিসমূহ নারী ও পুরুষের জন্য সমান শিক্ষা-সুবিধা নিশ্চিত করে অগ্রগতির পথে অগ্রসর হয়েছে। আমাদের ঐতিহ্যবাহী পরিবার কাঠামো, সামাজিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধের প্রেক্ষিতে শিক্ষিত নারীর কদর সর্বাধিক। আজও আমাদের পরিবারের কেন্দ্রে থাকেন একজন মা, যিনি শুধু সন্তানের জন্মদাত্রী নন, তার ওপরই নির্ভর করে পরিবারের সবকিছু। শিক্ষিত মায়ের সন্তান নিশ্চিতভাবেই যুগ সচেতন ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে। একজন শিক্ষিত মা যদি কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেন তাহলে পরিবার তথা দেশের উন্নয়নের অংশীদার হয়ে ওঠেন তিনি, আর যদি গৃহবধূই থাকেন তবে তিনি হন পরিবার তথা দেশের স্থপতি। শিক্ষিত মা সুচারুরূপে পরিবারের সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষাদান, কর্মবণ্টন, অর্থব্যবস্থাপনা, কর্মোদ্যোগ সৃষ্টি প্রভৃতি সম্পন্ন করার মাধ্যমে বস্তুত জাতি গঠনের প্রাথমিক কাজটিই করে থাকেন।
পরিবার থেকে সমাজ ও শেষ পর্যায়ে জাতীয় ক্ষেত্রে সমৃদ্ধি ও সংহতির কারিগর রূপে মাতৃসত্তার স্থান সবার উপরে। শুধু তাই নয়, প্রতিটি মানুষের দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্যরক্ষার জন্যে শিক্ষিত মাতার উপযোগিতাকে অবশ্যম্ভাবী বলতে হবে। কেননা শিক্ষিত মাতা পুষ্টিজ্ঞান, মানসিক পরিচর্যা, সুস্থ বিনোদন প্রক্রিয়া সবকিছু সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পোষণ করেন।
অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য নারীশিক্ষা
যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির প্রথম শর্ত শিক্ষিত ও কর্মদক্ষ জনশক্তি। একজন। প্রশিক্ষিত মানুষের অর্থনৈতিক অবদান তথা উৎপাদন কর্মকান্ড যেখানে শারীরিক শ্রমনির্ভর সেখানে শিক্ষিত মায়ের অবদান। মেধানির্ভর। আজকের বিজ্ঞান শাসিত যুগে প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে শারীরিক শ্রমের গুরুত্ব দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। দেশকে কাঙিক্ষত অর্থনৈতিক উন্নতি এনে দিতে চাইলে সুশিক্ষিত কর্মীবাহিনী প্রয়োজন। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে শ্রমের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত হলে আমাদের মতো অধিক জনসংখ্যার দেশ জনশক্তি রপ্তানি করেই বিপুল অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটাতে পারবে।
তবে জনশক্তি যে কেবল পুরুষদের নিয়ে গঠিত হয় না এবং আধুনিক শিক্ষাবিহীন মানুষ জনশক্তি বলে গণ্য হয় না সেটি আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। জানা যায়, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে বিপুল পরিমাণ নার্স, ডাক্তার, শিক্ষক ও আটটি দক্ষ নারীকর্মীর প্রয়োজন। বাংলাদেশ থেকে এ ধরনের দক্ষ নারীকর্মী ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো নিতে চায়। সেজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন নারী ও পুরুষকে সমমানের শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা।
নারীর ক্ষমতায়নে শিক্ষা
আর্থসামাজিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে আমাদের দেশে নারীর অংশগ্রহণ এখনও সীমিত পর্যায়ে রয়েছে। পারিবারিক ক্ষেত্রেও নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা যথেষ্ট কম। নারীর ক্ষমতায়নের পথে বাধা বিদ্যমান। এক্ষেত্রে পুরুষশাসিত সমাজ ও পুরুষ নিজেই নারীকে প্রধানত ক্ষমতা থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। কিন্তু একথাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সর্বক্ষেত্রে আত্মপ্রতিষ্ঠায় নারী প্রয়োজনীয় সামর্থ্য অর্জনেও পিছিয়ে রয়েছে।
নারীশিক্ষার প্রকৃতি
নারীর উপযুক্ত শিক্ষা কেমন হওয়া উচিত এ নিয়ে নানা মত থাকতে পারে। তবে নারীশিক্ষার প্রকৃতি একটু স্বতন্ত্র হওয়াই বাঞ্ছনীয়। বস্তুত নারীশিক্ষার দুটি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। প্রথমত, নারীকে কর্মদক্ষ করে তোলার জন্যে প্রযুক্তিজ্ঞান দান এবং দ্বিতীয়ত তার বহুযুগের মনোগত পশ্চাৎপদতা কাটিয়ে ওঠার মধ্যে উন্নত মানসিক শিক্ষা নিশ্চিত করা। এ ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ বলেন, "মেয়েদের মানুষ হইতে শিখাইবার জন্য বিশুদ্ধ জ্ঞানের শিক্ষা চাই। কিন্তু তাহার উপরে মেয়েদের মেয়ে হইতে শিখাইবার জন্যে যে ব্যবহারিক শিক্ষা তার একটা বিশেষত্ব আছে, এটা মানিতে দোষ কী?" তাই বলা যায়, নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র পাঠ্যক্রম অনুসরণ করা হলে সুফল আসবে।
আশান্বিত হবার লক্ষণ
একুশ শতকের এই মাহেন্দ্রক্ষণে সারা বিশ্ব যখন নতুন উৎসবমন্ত্রে জেগে উঠেছে তখন আমাদের সমাজ ও দেশ তাতে সাড়া না দিয়ে পারেনি। ধীরে ধীরে নারীশিক্ষা নিয়ে বিভ্রান্তির ঘোর কাটতে শুরু করেছে। জনমনে সচেতনতা ও সরকারিভাবে ইতিবাচক উদ্যোগের প্রভাব লক্ষ্যযোগ্য হয়ে উঠেছে। সরকার কলেজ পর্যায় পর্যন্ত নারীশিক্ষাকে অবৈতনিক করা ছাড়াও ছাত্রী উপবৃত্তি চালু করেছে। মেয়েদের জন্য আলাদা পলিটেকনিক, ক্যাডেট কলেজ প্রভৃতি স্থাপন করেছে। বেসরকারি ও বিদেশি সাহায্য সংস্থাগুলোও নারীশিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
সরকারি চাকরিক্ষেত্রে নারী কোটা সংরক্ষণ ও প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নারীদের প্রবেশাধিকারকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে মেয়ে শিশুদের সংখ্যা লক্ষণীয় হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সাথে ঝরে পড়ার এ হার শতকরা ৪০ ভাগ থেকে ২৭ ভাগে কমে এসেছে। আশা করা যায়, এ ধারা অব্যাহত থাকবে এবং অদূর ভবিষ্যতে নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে বিপ্লব সৃষ্টি হবে।
নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপসংহার
আমাদের আর্থসামাজিক অনুন্নয়নের পেছনে যেসব কারণ সক্রিয় রয়েছে তার মধ্যে নারীশিক্ষার অভাব অন্যতম। আমরা যদি সর্বোতভাবে উন্নতি দেখতে চাই, তাহলে নারীদের অবশ্যই শিক্ষার মূলস্রোতে আনতে হবে। অন্যথায়, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে আমরা ব্যর্থ হব এবং প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ব থেকে আমরা দ্রুতই পিছিয়ে পড়ব।