তাপসী রাবেয়া বসরী এর জীবনী (সম্পূর্ণ)
তাপসী রাবেয়া বসরী এর জীবনীঃ আসসালামু আলাইকুম বন্ধুরা, আশা করছি আল্লাহর রহমতে সবাই ভালো আছেন। আজকে আমরা তাপসী রাবেয়া বসরী এর জীবনী সম্পর্কে কথা বলবো। তাই আপনারা যারা গুগলে সার্চ করছেন তাপসী রাবেয়া বসরী এর জীবনী তারা আজকের এই আর্টিকেলটির মাধ্যমে তা জানতে পারবেন।
রাবেয়া বসরী ছিলেন ইসলামের অন্যতম একজন মহীয়সী নারী। তিনি নিজের সম্পূর্ণ জীবন উৎসর্গ করেছিলেন মহান আল্লাহর ইবাদতে। তাহলে চলুন তাপসী রাবেয়া বসরী এর জীবনী বিস্তারিতভাবে জানা যাক।
সংক্ষিপ্ত তথ্য
নাম – রাবেয়া বসরী আল আদাবিয়া (র)
উপাধি – আল বসরী
জন্মস্থান- ইরাকের বসরা নগর
জন্ম – ৭১৩ খ্রি.
পিতার নাম – ইসমাঈল
মাতার নাম – মায়ফুল
গুরু – ইমাম হাসান বসরী আল আনসারী
ওফাত – ৮০১ খ্রি. জাতীয়তা – আরবীয়
আরও পড়ুনঃ হযরত মুসা (আঃ) এর জীবনী
তাপসী রাবেয়া কে ছিলেন। জন্ম ও পরিচয়
যুগে যুগে পৃথিবীতে এমন ব্যক্তিবর্গও এসেছেন যারা মহান আল্লাহর অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। তাঁরা নবি-রাসুলগণের অনুসরণে মানুষকে সত্যপথের সন্ধান দিয়েছেন। এমনই একজন মহান ব্যক্তি ছিলেন হযরত রাবিয়া বসরি (রহ.)।
হযরত রাবিয়া বসরি (রহ.) ৯৯ হিজরি মোতাবেক ৭১৭ খ্রিষ্টাব্দে ইরাকের বসরা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাই তাঁকে বসরি বলা হয়। তাঁর পিতার নাম ইসমাঈল এবং মাতার নাম মায়ফুল। তাঁর পিতা খুব দরিদ্র ছিলেন।
যেদিন রাতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন, ঐ দিন রাতে তার পিতার ঘরে প্রদীপ জ্বালানোর মতো তেলও ছিল না। চার বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ ছিলেন। তাই তাঁর নাম রাখা হলো রাবিয়া (চতুর্থ)। শৈশবে তাঁর পিতামাতা ইন্তিকাল করেন। ফলে তাঁকে অতি কষ্টে দিনাতিপাত করতে হয়।
তাপসী রাবেয়া বসরী এর শিক্ষাজীবন
হযরত রাবিয়া বসরি (রহ.) খুব অল্প বয়সেই মা-বাবার কাছ থেকে কুরআন, হাদিস, ফিকহশাস্ত্রের জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে তার কখনো কোনো সংকোচ ছিল না। তিনি দরিদ্র হলেও পরম ধার্মিক ও আল্লাহভক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন ভদ্র, নম্র ও সংযমী। সেই সঙ্গে প্রখর বুদ্ধিমত্তার অধিকারিণী। সব সময় গভীর চিন্তায় ধ্যানমগ্ন হয়ে যেতেন। রাগ, হিংসা, অহংকার তাঁর চরিত্রকে কখনো কলুষিত করতে পারেনি। মোটকথা আল্লাহর একজন প্রকৃত অলি হওয়ার জন্য যে গুণাবলি থাকা প্রয়োজন এর সব কিছুই তাঁর মধ্যে বিদ্যমান ছিল। দীর্ঘ সাধনার পর রাবিয়া বসরি (রহ.) ইলমে তাসাউফ ও মারেফাতের সূক্ষ্ম জ্ঞান অর্জন করেন। পরবর্তী সময়ে রাবিয়া একজন কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
রাবেয়া বসরীর ক্রীতদাসীর জীবন
হযরত রাবিয়া বসরি (রহ.)-এর মাতা-পিতার ইন্তিকালের পর তার বড় বোনেরা জীবন ও জীবিকার অন্বেষণে অন্যত্র চলে যান। নিঃসঙ্গ রাবিয়া বসরি (রহ.) কান্নাকাটি করে কাটাতে লাগলেন দিনের পর দিন। হঠাৎ এক পাষন্ড এসে জোর করে তুলে নিয়ে গেল রাবিয়া বসরি (রহ.)-কে। দাসী কেনাবেচার হাটে নিয়ে তাঁকে বিক্রি করে দিল পাষাণহৃদয় এক ব্যক্তির নিকট। ক্রীতদাসীতে পরিণত হলেন রাবিয়া বসরি (রহ.)। তিনি দিনের বেলায় কঠোর পরিশ্রম করতেন। রাতের বেলায় জাগ্রত থেকে আল্লাহ তা'আলার ইবাদাত করতেন। হঠাৎ এক মাঝরাতে তাঁর মনিবের ঘুম ভেঙে যায়।
মনিব অস্পষ্ট কিছু কথার গুঞ্জন শুনতে পান। গভীর অন্ধকারে কার কথার শব্দ? খুঁজতে যেয়ে দেখতে পান রাবিয়া ইবাদাত করছে। আকুল স্বরে প্রার্থনা করছে প্রভুর দরবারে। একপর্যায়ে রাবিয়া মোনাজাত ধরে আল্লাহ তা'আলার দরবারে বললেন, হে আল্লাহ। তুমি আমাকে কোনো মানুষের অধীন করে না রাখলে আমি সর্বক্ষণ শুধু তোমার ইবাদাত করতাম। রাবিয়ার আকুল প্রার্থনা শুনে মনিবের মন গলে যায়। মনিব মনে মনে বলল, হায়। এ আমি কাকে আমার ঘরে দাসী বানিয়ে রেখেছি? সে তো সামান্য নারী হতে পারে না। সে নিশ্চয় আল্লাহর প্রিয়জন।
এ ঘটনার পরদিন সকালে মনিব রাবিয়া বসরি (রহ.)-কে দাসত জীবন থেকে মুক্ত করলেন। এবার রাবিয়া বসরি (রহ.) মুক্ত হয়ে নিজের জীবনকে তিনি উৎসর্গ করলেন প্রভুর ইবাদাতে। তিনি জীবনে বিয়ে করেননি। কেবল আল্লাহ তা'আলার ইবাদাতে কাটিয়ে দেন।
আল্লাহর ওপর আস্থা ও ইবাদাত
তাপসী রাবিয়া বসরি (রহ.) আল্লাহর ওপর বেশি নির্ভরশীল ছিলেন। তিনি জীর্ণ কুটিরে বসবাস করতেন। তবু কোনো মানুষের সাহায্য গ্রহণ করতেন না। একবার হযরত রাবিয়া বসরি (রহ.) অসুস্থ হলে আব্দুল ওয়াহিদ আমর ও প্রখ্যাত মুহাদ্দিস সুফিয়ান সাওরি তাঁকে দেখতে যান। তখন সুফিয়ান সাওরি হযরত রাবিয়া বসরি (রহ.)-কে বললেন, যদি আপনি দোয়া করেন, তাহলে আল্লাহ তা'আলা আপনাকে সুস্থ করে দেবেন। রাবিয়া বসরি (রহ.) বললেন, হে আবু সুফিয়ান। আপনি কি জানেন না কার ইচ্ছায় আমার এ অসুস্থতা? যার ইচ্ছা, তিনি কি আল্লাহ তা'আলা নন? সুফিয়ান বললেন, হ্যাঁ। রাবিয়া বসরি (রহ) বললেন, তাহলে কেন আমাকে আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রার্থনা করতে বলছেন।
মালিক ইবনে দিনার একজন বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি রাবিয়া বসরি (রহ.)-এর পরিচিত ছিলেন। তিনি একদা রাবিয়ার আর্থিক দুরবস্থা দেখে বললেন, আপনি বললে আমি আমার এক ধনী বন্ধু থেকে আপনার জন্য সাহায্য আনতে পারি। রাবিয়া বললেন, হে মালিক। আমাকে এবং আপনার বন্ধুকে কি আল্লাহই রিযিক দেন না? মালিক বলল, হ্যাঁ। রাবিয়া বললেন, আল্লাহ কি দরিদ্রকে তার দারিদ্র্যের কারণে ভুলে যাবেন এবং ধনীদের তাদের ধনসম্পদের কারণে মনে রাখবেন? মালিক বলল, না। তখন রাবিয়া বললেন, আল্লাহ যেহেতু আমার অবস্থা জানেন, তখন তাকে আমার আবার স্মরণ করানোর দরকার কী?
বিশিষ্ট আরবি সাহিত্যিক আল জাহিজ বলেন, রাবিয়ার কয়েকজন পরিচিত লোক তাঁকে বললেন, আমরা যদি আপনার আত্মীয়স্বজনদের বলি তাহলে তারা আপনাকে একজন ক্রীতদাস কিনে দেবেন। রাবিয়া বললেন, সত্য কথা এই যে, যিনি সমস্ত পৃথিবীর মালিক, তার কাছেই পার্থিব কিছু চাইতে আমার লজ্জা হয়। অতএব যারা পৃথিবীর মালিক নয় তাদের কাছে কী করে আমি চাইতে পারি?
ইবাদাত করার ক্ষেত্রে হযরত রাবিয়া বসরি (রহ.) ছিলেন অতুলনীয়। তিনি যখনই সময় পেতেন, তখনই আল্লাহ তা'আলার ইবাদাতে ব্যস্ত হয়ে যেতেন। অধিকাংশ সময় তিনি দিনে রোযা রাখতেন আর রাতে নফল সালাত আদায় করতেন। তিনি সর্বদা আল্লাহ তা'আলার নিকট এ বলে প্রার্থনা করতেন যে, হে প্রভু। আমাকে আমার নিজ কাজে (ইবাদাতে) ব্যস্ত রাখুন যাতে আমাকে কেউ আপনার যিকির হতে বিমুখ করতে না পারে।
রাবেয়া বসরী অলৌকিক ঘটনা
শুধু পুরুষরাই আল্লাহর নৈকট্য লাভ করেছে এমন নয়। অনেক নারীও আল্লাহর অলি হয়েছেন। আল্লাহ তাদের অনেক আধ্যাত্মিক ক্ষমতা দিয়েছেন। হযরত রাবেয়া বসরি (রহ.)-এরও অনেক আধ্যাত্মিক ক্ষমতা ছিল।
ঘটনা০১ঃ একবার হযরত রাবিয়া বসরি (রহ.) খাবার রান্না করতে গেছেন। দেখেন পেঁয়াজ নেই। ভাবছেন, পেঁয়াজ কোথা থেকে আনব, কীভাবে আনব, কোনো দাস-দাসী নেই। সেবক সেবিকা নেই। মনে মনে এ কথাই ভাবছিলেন। এমন সময় লক্ষ করলেন, একটি চিল উড়ে যাচ্ছে। তাঁর পায়ে পেঁয়াজ। চিল পেঁয়াজগুলো জুড়ে মারল, আর তা সোজা হযরত রাবিয়ার কাছে এসে পড়ল। তাঁকে বলা হলো, রাবিয়া। তুমি আমার হয়ে গেছ, আমি চিলকে তোমার সেবায় নিয়োজিত করলাম।
ঘটনা০২ঃ হযরত রাবিয়া বসরি (রহ.) একবার শস্য বুনছিলেন। পঙ্গপাল শস্যক্ষেতের ওপর এসে পড়েছিল। তখন রাবিয়া প্রার্থনা করে বললেন, হে আমার প্রভু। এ হলো আমার জীবিকা। যদি আপনি চান তাহলে আমি তা আপনার শত্রুদের বা বন্ধুদের দিয়ে দেব। তখন পঙ্গপাল উড়ে পালিয়ে গেল।
আল্লাহর অলিদের বহু অলৌকিক ঘটনা রয়েছে। তবে তারা এসব ক্ষমতা নিয়ে কখনো অহংকার করেননি। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে কখনো তা প্রকাশ করেননি; বরং তা আপনা আপনি প্রকাশিত হয়ে যেত।
তাপসী রাবেয়া বসরী এর ইন্তিকাল
অনেক শ্রম, কষ্টসাধ্য ও আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ জীবনযাপন করার পর আল্লাহর প্রিয় এই নারী ১৮৫ হিজরি মোতাবেক ৮০১ খ্রিষ্টাব্দে বসরায় ইন্তিকাল করেন। তাঁকে বসরায় দাফন করা হয়।
"বর্ণিত আছে যে, মুহাম্মাদ ইবনে তুসি নামক এক লোক তাঁর কবরে যান। গিয়ে বলেন যে, হে রাবিয়া, আপনি গর্ব করতেন যে, উভয় জগতের বিনিময়েও আপনি আপনার মাথা নত করবেন না। আপনি কি সেই উন্নত অবস্থা লাভ করেছেন? জবাবে একটি আওয়াজ এলো, আমি যা চেয়েছিলাম তা আমি পেয়েছি। আমরা তাঁর জীবনের আলোকে আমাদের জীবন গড়ব। ইহকাল ও পরকালে শান্তি পাব।" (কালেক্টেড-NCTB)